অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল নিয়ে এতদিন যে অনিশ্চয়তা ছিল সেটির অবসান ঘটেছে। মুহাম্মদ ইউনূস একইসঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন। এতে জুলাই বিপ্লবকে পরিচালিত করা মৌলিক নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত আছে। রাজনৈতিক দলগুলোও জুলাই সনদে একমত হয়েছে। এই সনদে তারা আরেকটি স্বৈরাচারী সরকারের উত্থান রোধে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ও সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে এই ঐকমত্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ সুগম করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের এক মূল্যায়নে এসব কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে। গতকাল বুধবার মূল্যায়নটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে কাউন্সিল। এটি লিখেছেন কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ ফেলো এম ওসমান সিদ্দিক ও ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোভিজ।
মূল্যায়নে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বিদায়ের পর যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের শাসনামলে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তাতে এ কাজ মোটেও সহজ ছিল না। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। আরেকটি কৃতিত্বের বিষয় হলো, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদাররা-যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল; অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি সরকারের সংস্কার প্রচার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির জন্য একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক জোট গঠন করেছেন। বাংলাদেশ ঐতিহ্যবাহী অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে কাজ করেছেন। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশটির সঙ্গে হাসিনা সরকারের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। কয়েক মাস আলোচনার পর গত ৩১ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকার ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য কাঠামোর চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের সময় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ হবে। একই সময়ে, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। মুহাম্মদ ইউনূস গত মার্চ মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এপ্রিলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও ইউনূসের বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু এখনো দেশটির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে।
আটলান্টিক কাউন্সিল বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হাসিনা সরকারের আমলে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা ও ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দেওয়া। এই অপরাধের মাত্রা কেবল জুলাই, আগস্টের ভয়াবহতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আগের অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম এবং অন্যান্য নিপীড়নও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ন্যায়বিচারের এই প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে। কারণ, অভিযুক্ত অনেক ব্যক্তি সরকার পতনের সময়কার বিশৃঙ্খলার সুযোগে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা ও তাঁর অনেক সহযোগী ভারতে আশ্রয় পেয়েছেন।
জনসংখ্যা বিবেচনায় অষ্টম হওয়া স্বত্বেও বিশ্বে তেমন মনোযোগ পায় না বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথাও খুব কম সংখ্যক বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশের ঘটনাগুলোতে নিবিড়ভাবে নজর রাখেন। আর এ কারণেই যারা বাংলাদেশ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে চায় তাদের পক্ষে কাজটা সহজ হয়। গণঅভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে এমনটাই ঘটেছে।
কাউন্সিলের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, গত এক বছরে একটি বয়ান তৈরি হয়েছে যে- শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। ইসলামি উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে এবং দেশটিকে চীনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবের কোনোটিই সঠিক নয়। বরং নতুন নির্বাচনের পথে অগ্রসর হওয়ার সময় সত্য তথ্য তুলে ধরাটা জরুরি।
গত পনেরো বছরের শাসনামলে হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে ক্রমশ বিশ্বের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল এবং বাকস্বাধীনতার ওপর কঠোরভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। এখন দেশটি আবার বিশ্ববাসীর জন্য দ্বার উন্মুক্ত করেছে। তাই অর্থনীতি শক্তিশালী করা, হাসিনা সরকারের অপরাধের জন্য বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় বিশ্বের উচিত বাংলাদেশকে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা।