নিউইয়র্কের আবহাওয়া সেদিন ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে বাতাস এতটাই আর্দ্র ছিল যে, তা কুয়াশার মতো দেখাচ্ছিল। এর মধ্যেই জাতিসংঘ সদরদপ্তর থেকে সদলবলে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। সামনে রাখা গাড়িতে উঠে যখন রওনা দিলেন, তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছিল।
ঘটনাটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বরের। আর জাতিসংঘ সদরদপ্তর থেকে গাড়িতে করে চলে যাওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন থেকে তাঁর সেদিন হুট করে চলে যাওয়ার ছবিটি পরদিন প্রকাশ হয় নিউইয়র্ক টাইমসের পাতায়।
প্রতিবেদনে মার্কিন গণমাধ্যমটি লিখেছে, ভুট্টোর চোখও সেদিন অশ্রুসিক্ত ছিল। অধিবেশনে তিনি আবেগঘন বক্তব্য দেন। জাতিসংঘের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, সংস্থাটি আগ্রাসনকে বৈধতা দিচ্ছে। এক পর্যায়ে বলেন, ‘রাখুন আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ। লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের সঙ্গে আমি যুক্ত হবো না। আমি কোনো ইঁদুর নই। পালাচ্ছি না, পরিষদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’
ভুট্টো চলে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা পরিষদের দ্বিতীয় দফার অধিবেশনে সেদিন পৃথক দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফ্রান্স-ব্রিটেনের যৌথ প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি ও পূর্ব পাকিস্তানের ‘বিদ্রোহী’দের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার আহ্বান জানানো হয়। সোভিয়েতের পক্ষ থেকেও একই রকম প্রস্তাব ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, কূটনীতিকরা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঢাকায় পতন আসন্ন।
১৬ ঘণ্টার আলটিমেটাম
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহর ও ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর পাকিস্তানের শাসকরা তাদের সম্ভাব্য পরাজয় সম্পর্কে অনেকটাই নিশ্চিত হন। যেমন- ১৪ ডিসেম্বরই জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে একটি চিঠি পাঠিয়ে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
ওই চিঠির একটি অনুলিপি নিজের লেখা বই ‘স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’য় তুলে ধরেছেন ভারতের তৎকালীন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। নিয়াজিকে উদ্দেশ করে ইয়াহিয়া লিখেন, প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা আর কার্যকর হবে না। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অভিযান বন্ধ, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি জাতিসংঘে এরই মধ্যে তৎপরতা চালিয়েছেন।
ইয়াহিয়ার ওই বার্তা পাওয়ার পর জেনারেল নিয়াজি ও ঢাকায় গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা ফরমান আলী দেখা করেন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভ্যাকের সঙ্গে। স্পিভ্যাককে তারা ‘সম্মানজনক শর্তসাপেক্ষে যুদ্ধবিরতি’ সংক্রান্ত একটি বার্তা ভারতের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করেন। স্পিভ্যাক বার্তাটি দিল্লির বদলে ওয়াশিংটনে পাঠান। সেখান থেকে বার্তাটি ভারতের তৎকালীন সেনা প্রধান শ্যাম মানেকশের কাছে যায়।
চিঠিটি শ্যাম মানেকশের কাছে পৌঁছেছিল ১৫ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটার দিকে। এরপর তিনি নিয়াজিকে ওই বার্তার জবাব দেন। এর লিখিত রূপ প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা এপি। যেখানে জেনারেল মানেকশ বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী যদি আত্মসমর্পণ করে, তবেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। ভারতের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এরই মধ্যে ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেনারেল মানেকশ ওই বার্তায় আত্মসমর্পণের সময়সীমা দিয়েছিলেন পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত। যদিও জে এফ আর জ্যাকব তাঁর বইয়ে লিখেছেন, এ সময় পরে আরও কয়েক ঘণ্টা (৩টা পর্যন্ত) বাড়ানো হয়েছিল।
যুদ্ধের শেষ দিনটিতে একদিকে আত্মসমর্পণ-সংক্রান্ত বার্তা চালাচালি হচ্ছিল, অন্যদিকে আকাশপথে দিনভর পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন বাঙ্কার, আবাসস্থল, কমান্ড-কেন্দ্রের ওপর উড়ছিল ভারতীয় যুদ্ধবিমান। বোমা বর্ষণ ঠেকাতে পাকিস্তানিরাও নানা কৌশল অবলম্বন করে।
দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা: ৭১’ এ লেখা হয়েছে, কোনো কোনো পাকিস্তানি বাঙ্কারের ওপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে ভারতীয় বিমান ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। কেননা, আত্মরক্ষার্থে পাকিস্তানিরা সেসব বাঙ্কারের ছাদে হাত-পা বেঁধে স্থানীয়দের শুইয়ে রেখেছিল।
অন্যদিকে স্থলপথে ঢাকায় অগ্রসরের গতি বাড়াচ্ছিলেন মুক্তি ও ভারতীয় সেনারা। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, অন্য সময়ের তুলনায় সেদিন মুক্তিবাহিনীর ঢাকামুখী যাত্রাটা ছিল অনেকটা বিজয়ীর মতো। মানুষ নদীর তীর কিংবা গ্রামের পথে তাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। আর নদীতে ভাসতে থাকা লাশের ওপর তখন উড়ছিল কাক।